গাজর "Carrot"
গাজর "Carrot"
গাজর, যা ইংরেজিতে "Carrot" নামে পরিচিত, একটি জনপ্রিয় এবং পুষ্টিকর শাকসবজি। এর বৈজ্ঞানিক নাম হলো "Daucus carota." গাজর সাধারণত কমলা রঙের হয়ে থাকে, তবে এটি বেগুনি, সাদা, এবং হলুদ রঙের ও পাওয়া যায়।
গাজরের উৎপত্তি:
গাজরের মূল
উৎপত্তিস্থল হলো মধ্য এশিয়া, বিশেষ করে আফগানিস্তান ও ইরান অঞ্চল। প্রায় ৫০০০ বছর আগে এই
অঞ্চলে গাজরের চাষ শুরু হয়। প্রথমদিকে গাজর ছিল বুনো ও রঙে মূলত বেগুনি বা হলুদ।
ধীরে ধীরে এটি বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং ইউরোপে এসে এর কমলা রঙের গাজরের বিকাশ
ঘটে। গাজরের আধুনিক জাতগুলি মূলত ১৬শ শতকের দিকে নেদারল্যান্ডসে বিকাশ লাভ করে, যেখানে কৃষকরা
গাজরের রঙ এবং স্বাদ উন্নত করতে কাজ শুরু করেন। এরপর থেকে গাজর বিভিন্ন রঙে (কমলা, হলুদ, সাদা, বেগুনি) এবং
স্বাদে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
গাজরের পুষ্টিগুণ ও স্বাস্থ্য উপকারিতা:


১. পুষ্টি: গাজর ভিটামিন A, C, K, এবং ফাইবারে সমৃদ্ধ। এটি
বিটা-ক্যারোটিনের ভালো উৎস, যা শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী।
২. . দৃষ্টিশক্তি উন্নত করে: গাজরে প্রচুর বিটা-ক্যারোটিন
থাকে, যা শরীরে ভিটামিন A-তে রূপান্তরিত হয় এবং চোখের স্বাস্থ্য রক্ষা করে। এটি রাতকানা
ও অন্যান্য চোখের সমস্যার ঝুঁকি কমায়।
৩. হৃদরোগের ঝুঁকি কমানো: গাজরে থাকা ফাইবার ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়।
৪. হজমে সহায়তা: গাজরের ফাইবার হজমে সহায়তা করে এবং পেটের
সমস্যা অর্থাৎ কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে।
৫. ত্বকের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে: গাজরের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট
ও পটাশিইয়াম ত্বককে উজ্জ্বল ও মসৃণ রাখতে সাহায্য করে। এটি ত্বকের বলিরেখা ও বয়সের
ছাপ কমাতে সহায়ক।
৬. ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক: গাজরে থাকা
ক্যারোটিনয়েড ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীরের ক্ষতিকর কোষের বৃদ্ধি রোধ করে, যা ক্যান্সার
প্রতিরোধে সহায়তা করে।
৭. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়: গাজরে থাকা
ভিটামিন C শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে, যা বিভিন্ন সংক্রমণ প্রতিরোধে সহায়ক।
৮. স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করে: গাজরের বিটা-ক্যারোটিন
মস্তিষ্কের কোষ রক্ষা করে এবং স্মৃতিশক্তি উন্নত করতে সাহায্য করে।
গাজরের পুষ্টি উপাদান:
১০০ গ্রাম গাজরের পুষ্টি উপাদান নিচে দেওয়া হলো (আসন্ন):
শক্তি (Energy): ৪১ কিলোক্যালরি
কার্বোহাইড্রেট: ৯.৬ গ্রাম
চিনি: ৪.৭ গ্রাম
আঁশ (Fiber): ২.৮ গ্রাম
প্রোটিন: ০.৯ গ্রাম
চর্বি (Fat): ০.২ গ্রাম
ভিটামিন A (বেটা ক্যারোটিন): ১৬,৭০৬ IU (দৈনিক চাহিদার ৩৩৪%)
ভিটামিন C: ৫.৯ মি.গ্রা.
ভিটামিন K: ১৩.২ µg
ভিটামিন B6: ০.১ মি.গ্রা.
পটাশিয়াম: ৩২০ মি.গ্রা.
ক্যালসিয়াম: ৩৩ মি.গ্রা.
লোহা (Iron): ০.৩ মি.গ্রা.
ম্যাগনেশিয়াম: ১২ মি.গ্রা.
গাজর ভিটামিন A-এর অন্যতম উৎকৃষ্ট উৎস, যা দৃষ্টিশক্তি, ত্বক ও রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।
গাজর এর অপকারিতা:
১. অতিরিক্ত খাওয়া: অতিরিক্ত গাজর খেলে
ত্বকে হলুদ ভাব আসতে পারে, যা "কারোটেনেমিইয়া" নামে পরিচিত।
২. শর্করা: গাজরে কিছু পরিমাণ শর্করা থাকে,
তাই ডাইয়াবেটিস রোগীদের জন্য এটি সীমিত পরিমাণে খাওয়া উচিত।
গাজরের ব্যবহার:
গাজর (Carrot) একটি পুষ্টিকর ও উপকারী শীতকালীন
সবজি, যা সারা বছরই সহজলভ্য। গাজর কাঁচা, রান্না করা, অথবা রস হিসেবে খাওয়া যায় এবং
এটি সালাদ, স্যুপ, হালুয়া, খিচুড়ি কেক, এবং পুডিং তৈরি ইত্যাদিতে ব্যবহৃত হয়।গাজরের
রস ও মধু মিশিয়ে ত্বকে প্রয়োগ করলে ত্বক উজ্জ্বল হয়।
গাজর (Daucus carota) বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয়
শীতকালীন সবজি, যা পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ এবং চাষে লাভজনক।
গাজর চাষের বিস্তারিত পদ্ধতি তুলে ধরা হলো:
উপযুক্ত মাটি ও জলবায়ু:
মাটি: বেলে দোঁআশ
বা দোআঁশ মাটি গাজর চাষের জন্য উপযোগী।
জমি: উঁচু ও পানি
নিষ্কাশনের সুবিধাযুক্ত জমি নির্বাচন করুন।
আবহাওয়া: ঠান্ডা
ও রোদযুক্ত পরিবেশে গাজরের ফলন ভালো হয়।
বীজ বপনের সময়
সময়: আশ্বিন থেকে
পৌষ মাস (মধ্য সেপ্টেম্বর থেকে মধ্য ডিসেম্বর) গাজরের বীজ বপনের উপযুক্ত সময়।
বীজ বপনঃ
বীজ হার: প্রতি হেক্টরে ৩–৪ কেজি বীজ প্রয়োজন।
সারি দূরত্ব: সারি থেকে সারি ২০–২৫ সেমি এবং গাছ থেকে গাছ
১০ সেমি দূরত্ব বজায় রাখুন।
বপন পদ্ধতি: বীজ ছোট হওয়ায় ছাই বা গুঁড়া মাটির সঙ্গে মিশিয়ে
বপন করুন।
জমি প্রস্তুতিঃ
জমি ৮–১০ ইঞ্চি গভীর করে চাষ করুন।
৪–৫ বার চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করুন।
সারি করে বীজ বপন করলে পরিচর্যা সহজ হয়।
আগাছা ও সেচ নিয়ন্ত্রণঃ
আগাছা: বপনের ২৫–৩০ দিনের মধ্যে আগাছা পরিষ্কার করুন। সেচ
দেওয়ার আগে আগাছা বাছাই করুন।
সেচ: মাটির রস কমে গেলে সেচ দিন। শীত ও খরার সময় ১৫ দিন পরপর
সেচ দিন।
সার ব্যবস্থাপনা
প্রাথমিক সার (প্রতি হেক্টরে):
গোবর/কম্পোস্ট: ১০ টন
ইউরিয়া: ১৫০ কেজি
টিএসপি: ১২৫ কেজি
এমওপি: ২০০ কেজি
প্রয়োগ পদ্ধতি: সম্পূর্ণ গোবর ও টিএসপি এবং অর্ধেক ইউরিয়া
ও এমওপি জমি তৈরির সময় প্রয়োগ করুন।বাকি অর্ধেক ইউরিয়া ও এমওপি চারা গজানোর ১০–১২
দিন ও ৩৫–৪০ দিন পর উপরি প্রয়োগ করুন।
রোগ ও পোকামাকড় দমনঃ
পাতাপোড়া রোগ: টেবুকোনাজল+ট্রাইফ্লক্সিস্ট্রবিন বা প্রোপিকোনাজল
জাতীয় ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করুন।
জাব পোকা: ইমিডাক্লোরোপ্রিড জাতীয় কীটনাশক ব্যবহার করুন।
সতর্কতা: বালাইনাশক ব্যবহারের আগে নির্দেশাবলি মেনে চলুন
এবং সুরক্ষা পোশাক পরিধান করুন।
ফসল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ
ফসল সংগ্রহ: বীজ বপনের ৭০–৮০ দিন পর গাজর সংগ্রহের উপযুক্ত
সময়।
ফলন: প্রতি হেক্টরে গড়ে ২০–২৫ টন গাজর উৎপাদন হয়।
সংরক্ষণ: গাজর ঠান্ডা ও শীতল স্থানে সংরক্ষণ করুন।
মন্তব্যসমূহ