সজনে(Drumstick / Moringa)
সজনে(Drumstick বা Moringa)
পরিচয়:
সজনে গাছ, যা "মোরিঙ্গা" নামেও পরিচিত। এর বৈজ্ঞানিক নাম Moringa oleifera। সজনে একটি বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ। একটি অত্যন্ত পুষ্টিকর গাছ। সজনের পাতা, ডাঁটা (ফল) ও ফুল—তিনটিই খাওয়া যায়।
উৎপত্তি:
সজনে গাছের উৎপত্তি ভারতীয়
উপমহাদেশে,
বিশেষ করে হিমালয়ের পাদদেশ অঞ্চল। এটি
প্রাচীনকাল থেকেই চাষ করা হচ্ছে এবং বর্তমানে আফ্রিকা, দক্ষিণ
আমেরিকা এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বহু দেশে চাষ হচ্ছে। গরম ও শুষ্ক আবহাওয়ায় ভালো
জন্মায়।সজনে গাছ দ্রুত বৃদ্ধি পায়।
প্রকারভেদ:
সজনের একাধিক জাত রয়েছে, তবে
বাংলাদেশে প্রধানত দুটি ধরনের সজনে দেখা যায়:
1. বারোমাসি সজনে: বছরে একাধিকবার ফল
দেয়।
2. মৌসুমি সজনে: সাধারণত গ্রীষ্মকালে
(মার্চ-এপ্রিল) ফলে।
এছাড়াও বিভিন্ন
প্রকারভেদ রয়েছে, তবে সাধারণত দুটি প্রধান প্রকার দেখা
যায়:
১. Moringa oleifera: এটি সবচেয়ে সাধারণ প্রকার এবং এর পাতা, ফুল এবং
ফল সবই খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
২. Moringa stenopetala: এটি আফ্রিকায় বেশি দেখা যায় এবং এর পাতা ও ফুল খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
পুষ্টিগুণ:
সজনে একটি
পুষ্টিগুণে ভরপুর উদ্ভিদ। সজনে গাছ "সুপার ফুড"
হিসেবে পরিচিত,
কারণ এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, খনিজ, এবং প্রয়োজনীয় অ্যামিনো অ্যাসিড।
পাতায় রয়েছে: সজনে
পাতা উচ্চ প্রোটিনের উৎস, যা
শরীরের পেশী গঠনে সাহায্য করে। প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ, সি, বি কমপ্লেক্স, ক্যালসিয়াম,
আয়রন, পটাসিয়াম, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট
,প্রোটিন এবং আটটি অত্যাবশ্যকীয় অ্যামিনো
অ্যাসিড। সজনে
পাতায় দুধের চেয়ে বেশি ক্যালসিয়াম ও গাজরের চেয়ে বেশি ভিটামিন A থাকে।
ডাঁটায় রয়েছে:
ভিটামিন সি,
ভিটামিন এ, আয়রন, ক্যালসিয়াম, এবং পটাসিয়াম।
বীজে
রয়েছে: ভিটামিন ই, এবং একটি বিশেষ তেল যা "বেন
অয়েল" নামে পরিচিত।
মিনারেল: এতে
ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম, এবং আয়রনের মতো
মিনারেল রয়েছে, যা
হাড়ের স্বাস্থ্য এবং রক্তের স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট: সজনে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ, যা শরীরের কোষকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে।
ব্যবহার:
1.
পাতা: ভাজি, ভর্তা ও
ওষুধ তৈরিতে
ব্যবহার করা
হয়। অনেক
সময় শুকিয়ে
গুঁড়া করে
খাওয়া হয়।
সজনে
পাতাগুলি সালাদ, তরকারি, এবং স্যুপে ব্যবহার করা হয়। এটি পুষ্টির একটি ভালো উৎস।
2.
ফল(ডাঁটা):তরকারি, ডাল
বা ভর্তা
হিসেবে রান্না
করে খাওয়া
হয়।এটি বিভিন্ন রেসিপিতে
ব্যবহার করা হয়।
3.
ফুল: ভাজি বা
ভর্তা হিসেবে
খাওয়া হয়।
অনেকে রস
করে পান
করেন।সজনে ফুলগুলি ভাজা
বা তরকারিতে ব্যবহার করা হয় এবং এটি সুস্বাদু।
4.
বীজ: সজনে বীজ থেকে তেল উৎপাদন করা হয়, যা রান্নায় এবং ত্বকের যত্নে ব্যবহৃত হয়।
উপকারিতা:
1.
পুষ্টি: সজনে
পাতা ভিটামিন
A, C, এবং E, ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম, আয়রন এবং
প্রোটিনে সমৃদ্ধ।
2.
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট: রোগ
প্রতিরোধ ক্ষমতা
বাড়ায় এবং
শরীরকে শক্তি
জোগায়।
3.
প্রদাহ কমানো:
সজনে প্রদাহ
কমাতে সাহায্য
করে, যা
বিভিন্ন রোগের
ঝুঁকি কমায়।
4.
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ:
এটি রক্তচাপ
নিয়ন্ত্রণে সাহায্য
করে এবং
হৃদরোগের ঝুঁকি
কমায়।
5.
হজমে সহায়তা:
সজনে হজমে
সহায়ক এবং
পেটের সমস্যা
কমাতে সাহায্য করে।
এছাড়াও
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সাহায্য
করে, চোখ ও
হাড়ের জন্য
ভালো, ত্বক
ও চুলের
জন্য উপকারী।
অর্থনৈতিক গুরুত্ব:
সজনে কৃষকদের জন্য একটি লাভজনক ফসল।বাজারে এর উচ্চ চাহিদা রয়েছে এবং বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হয়।
সজনে গাছের কাঠও
নির্মাণ এবং আসবাবপত্র তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
গ্রামের বাজারে
ও শহরের সুপারশপে সজনে ফল ও পাতা বিক্রি হয়।
সজনে গাছের
বিভিন্ন অংশ ঔষধি গুণের জন্য ব্যবহৃত হয়, যা স্বাস্থ্যসেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
চাষাবাদ:
সজনে গাছের চাষাবাদ খুব সহজ এবং খরচও
তুলনামূলকভাবে কম। নিচে সজনে চাষের ধাপগুলো দেওয়া হলো:
১. জমি নির্বাচন:
উঁচু ও রোদযুক্ত জায়গা উপযুক্ত।দোঁআশ
বা বেলে-দোঁআশ মাটিতে ভালো জন্মে।পানি জমে না এমন জমি বেছে নিতে হবে।
২. চারা রোপণ:বীজ বা ডাল—দুইভাবেই চাষ করা যায়।১.৫–২ ফুট
লম্বা ও ১–২ ইঞ্চি মোটা ডাল রোপণ করা ভালো।৩ ফুট × ৩ ফুট
দূরত্বে রোপণ করলে ভালো ফলন হয়।
৩. গর্ত তৈরি:প্রতি গাছে একটি করে ১.৫
ফুট গভীর ও ১.৫ ফুট প্রশস্ত গর্ত করতে হয়।গর্তে গোবর, ছাই ও
মাটি মিশিয়ে পূরণ করতে হয়।
৪. সার ও পানি:প্রতি গর্তে ৫-৭ কেজি
গোবর, ২০০ গ্রাম টিএসপি ও ১০০ গ্রাম এমওপি সার প্রয়োগ করা যেতে
পারে।শুষ্ক মৌসুমে সপ্তাহে ১-২ বার পানি দিতে হয়।
৫. আগাছা ও পরিচর্যা:প্রতি ১৫-২০ দিন
পরপর আগাছা পরিষ্কার করতে হয়।রোগ ও পোকা দমন করতে প্রাকৃতিক কীটনাশক ব্যবহার করা
ভালো।
৬. ফলন:সাধারণত রোপণের ৬-৮ মাসের মধ্যে
ফল আসে।বারোমাসি জাত বছরে ২-৩ বার ফল দিতে পারে।
৭. সংগ্রহ:৮-১২ ইঞ্চি লম্বা হওয়ার পর
ফল সংগ্রহ করতে হয়।পাতা ও ফুলও বিক্রয়যোগ্য।