লটকন বা নটকো(Burmese Grape)

                             লটকন বা নটকো(Burmese Grape)

পরিচয় ও বৈজ্ঞানিক নাম: 


লটকন বা নটকোর ইংরেজি নাম Burmese Grape, আর বৈজ্ঞানিক নাম Baccaurea motleyana। এটি Phyllanthaceae পরিবারের অন্তর্ভুক্ত একটি ফলজাতীয় উদ্ভিদ। লটকনের বেশ কয়েকটি নাম রয়েছে; যেমন- হাড়ফাটা, বুগি, ডুবি, বুবি, কানাইজু, লটকা, লটকাউ, কিছুয়ান ইত্যাদি।লটকন গাছ মাঝারি আকৃতির এবং চিরসবুজ। এটি একটি ছোট, গোলাকার ফল যা সাধারণত লাল বা গোলাপী রঙের হয়। ফলটির বাইরের খোসা মসৃণ এবং কিছুটা কাঁটাযুক্ত। ভিতরে সাদা বা ক্রিম রঙের মিষ্টি এবং রসালো মাংস থাকে, যা একটি বড় বীজকে ঘিরে থাকে। লটকন ফলের স্বাদ অত্যন্ত মিষ্টি এবং সুগন্ধি।

উৎপত্তি ও বিস্তার: লটকনের উৎপত্তি চীনে, যেখানে এটি হাজার হাজার বছর ধরে চাষ করা হচ্ছে। এটি পরে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে। লটকনের আদি নিবাস দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, বিশেষ করে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া। বাংলাদেশে লটকন ফলের চাষ সাধারণত গ্রীষ্মকালীন মৌসুমে হয় এবং এটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাওয়া যায়।এদেশে নরসিংদীতেই লটকনের ফলন বেশি।

এছাড়া সিলেট, নেত্রকোণা, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাজীপুরএসব জেলায়ও ইদানীং বাণিজ্যিক ভিত্তিতে লটকনের চাষ হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে লটকন বিদেশেও রফতানি করা হয়।

লটকন একটি সুস্বাদু ও জনপ্রিয় মৌসুমি ফল, যা বাংলাদেশ, ভারত, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়ায় পাওয়া যায়। এটি মূলত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের ফল। বাংলাদেশে জুন-আগস্ট মাসে লটকনের মৌসুম। 

 

গাছ ও ফলের বিবরণ: 


লটকন গাছ সাধারণত ৩০-৪০ ফুট পর্যন্ত উঁচু হয়।লটকন গাছের কান্ড বেটে এবং উপরাংশ ঝোপালো। পুং এবং স্ত্রী গাছ আলাদা; যাতে আলাদা ধরনের হলুদ ফুল হয়, উভয় রকম ফুলই সুগন্ধি। ফলের আকার দুই থেকে পাঁচ সেমি হয়, যা থোকায় থোকায় ধরে। ফলের রঙ হলুদ। ।প্রতিটি থোকায় অনেকগুলো ফল থাকে। ফলের বাইরের অংশ হলুদাভ ও মসৃণ, শক্ত খোসার ভেতরে থাকে সাদা রঙের নরম টক-মিষ্টি স্বাদের শাঁস এবং ভেতরে একটি করে বীজ। ফলে ২-৫ টি বীজ হয়, বীজের গায়ে লাগানো রসালো ভক্ষ্য (খেতে রসযুক্ত, মসৃণ ও সুস্বাদু) অংশ থাকে, যা জাতভেদে টক বা টকমিষ্টি স্বাদের। এই ফল সরাসরি খাওয়া হয় বা জ্যাম তৈরি করা হয়। এর ছাল থেকে রঙ তৈরি করা হয় যা রেশম সুতা রাঙাতে ব্যবহৃত হয়।এর কাঠ নিম্নমানের। ছায়াযুক্ত স্থানেই এটি ভাল জন্মে।

 

পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা:

 লটকন ফল পুষ্টিকর এবং এতে বিভিন্ন ভিটামিন ও খনিজ রয়েছে। এটি ভিটামিন C, B6, এবং পটাসিয়াম সমৃদ্ধ। লটকন ফলের কিছু পুষ্টিগুণ হলো:

১. ভিটামিন C: এটি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে এবং ত্বককে উজ্জ্বল রাখে।

২. অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট: লটকনে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে, যা শরীরের কোষকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে। হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।

৩. ফাইবার: এটি হজমে সহায়তা করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করে।

৪. লোহা ও ক্যালসিয়াম:লোহা ও ক্যালসিয়াম রক্ত ও হাড়ের গঠনে সহায়ক।

৫. অ্যামাইনো অ্যাসিড ও এনজাইম :লটকনে আছে অ্যামাইনো অ্যাসিড ও এনজাইম যা দেহ গঠন ও কোষকলার সুস্থতায় সহায়তা করে।

 

অপকারিতা:  

লটকন সাধারণত ক্ষতিকর নয়, তবে অতিরিক্ত খেলে গ্যাস, অম্লতা বা ডায়রিয়া হতে পারে। যাদের অ্যালার্জি সমস্যা আছে তাদের সতর্কতার সাথে খাওয়া উচিত।

 

চাষাবাদ: 

লটকন উঁচু, জলনিষ্কাশনযুক্ত মাটিতে ভালো জন্মে। লটকন গাছ সাধারণত ১০-১৫ মিটার উচ্চতায় বৃদ্ধি পায় এবং এটি গ্রীষ্মমন্ডলীয় আবহাওয়ায় ভালো জন্মায়।

বীজ বা চারা রোপণের ৪-৫ বছরের মধ্যে ফল দিতে শুরু করে। একবার গাছ ফল দিতে শুরু করলে বহু বছর ধরে ফল দেয়। সঠিক পরিচর্যা ও সার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়।  লটকন গাছের চাষের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো:

মাটি: লটকন গাছের জন্য দোআঁশ বা বেলে মাটি সবচেয়ে ভালো।

পানি দেওয়া: গাছের জন্য নিয়মিত পানি দেওয়া প্রয়োজন, তবে জলাবদ্ধতা এড়াতে হবে।

সার প্রয়োগ: পচা সার এবং নাইট্রোজেন সমৃদ্ধ সার ব্যবহার করা উচিত।

 

অর্থনৈতিক গুরুত্ব: 


বর্তমানে লটকন একটি অর্থকরী ফল হিসেবে পরিচিত। বাজারে এর চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। দেশীয় বাজারের পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানির সম্ভাবনা রয়েছে।

 

উপসংহার: 

লটকন একটি সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর ফল, যা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য অনেক উপকারিতা নিয়ে আসে। এটি গ্রীষ্মকালীন মৌসুমে পাওয়া যায় এবং এর চাষ সহজ। তাই, আমাদের খাদ্য তালিকায় লটকন ফলের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা উচিত। এটি শুধু সুস্বাদু নয় বরং স্বাস্থ্যকরও। এর চাষ বৃদ্ধি পেলে কৃষকরা লাভবান হবে এবং দেশের অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

Next Post Previous Post

SVG Icons