তিতা করলা (Bitter Gourd)

 তিতা করলা (Bitter Gourd)
উপকারিতায় ভরপুর একটি ওষধিগুণসম্পন্ন সবজি

তিতা করলা (Bitter Gourd) এর পরিচয়:

তিতা করলা, যা ইংরেজিতে "Bitter Gourd" বা "Karela" নামে পরিচিত, একটি পুষ্টিকর এবং ঔষধি শাকসবজি। এটি দেখতে সবুজ রঙের, কাঁটা বা খাঁজযুক্ত ও লম্বাটে আকৃতির। এর স্বাদ অনেক তিতা হলেও পুষ্টিগুণ ও ঔষধিগুণে ভরপুর। এর বৈজ্ঞানিক নাম "Momordica charantia" এবং এটি Cucurbitaceae পরিবারের অন্তর্গত।এটি তিক্ত স্বাদযুক্ত একটি ফল, যা উচ্ছে বা করল্লা নামেও পরিচিত।

তিতা করলার উৎপত্তি ও বিকাশ:

করলার আদি নিবাস দক্ষিণ এশিয়া এবং আফ্রিকায়। ধারণা করা হয়, এটি ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে এসেছে এবং পরে চীন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ, দক্ষিণ আমেরিকা এবং আফ্রিকায় ছড়িয়ে পড়েছে। প্রাচীনকাল থেকেই এটি ঔষধি এবং খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এটি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ও উপ-গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে ভালো জন্মে। এটি প্রধানত গ্রীষ্মকালে চাষ করা হলেও বর্তমানে সারা বছরই এর চাষ করা যায়। 

তিতা করলার প্রকারভেদ / জাত:

তিতা করলার প্রকারভেদ / জাত

বৈশিষ্ট্য

দেশি জাত

আকারে ছোট, কাঁটাযুক্ত ও খুব তিতা

হাইব্রিড জাত

বড়, কম তিতা, বাণিজ্যিকভাবে জনপ্রিয়

লম্বা জাত

অধিক ফলনশীল ও রপ্তানিযোগ্য, লম্বা এবং পাতলা হয়, যা সাধারণত সালাদে ব্যবহৃত হয়

সবুজ করলা

এটি সাধারণত সবুজ রঙের এবং তীব্র তিক্ত স্বাদের হয়। এটি রান্নায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়

হালকা সবুজ করলা

এই জাতের করলার রঙ হালকা সবুজ এবং স্বাদ তুলনামূলকভাবে কম তিক্ত

 

তিতা করলার উপকারিতা:

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ: রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে, ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য উপকারী।

করলার রস ইনসুলিনের নিঃসরণ বাড়িয়ে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে।

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি: এতে থাকা ভিটামিন সি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।

ভিটামিন ও মিনারেল: করলায় ভিটামিন C, ভিটামিন A, এবং পটাসিয়াম রয়েছে, যা শরীরের জন্য উপকারী।

অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট: করলায় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে, যা শরীরের কোষকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে।

হজমশক্তি বৃদ্ধি:ক্ষুধা বাড়ায় এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।

ওজন কমাতে সহায়ক:করলার মধ্যে ক্যালোরি ও ফ্যাট এর পরিমাণ কম থাকায় এটি ওজন কমাতে সাহায্য করে।

ত্বকের যত্নে:করলার রস ত্বকের বিভিন্ন সমস্যা যেমন ব্রণ, ফুসকুড়ি, এবং সংক্রমণ কমাতে সাহায্য করে। 

শ্বাসকষ্ট কমাতে:করলার রস মধু ও পানির সাথে মিশিয়ে খেলে শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমা, ব্রঙ্কাইটিসের মতো সমস্যায় আরাম পাওয়া যায়।

লিভারের কার্যক্ষমতা বাড়ায় ও হজমে সহায়তা করে। 

ম্যালেরিয়া ও জন্ডিসে প্রাকৃতিক প্রতিকার হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

প্রতি ১০০ গ্রামে তিতা করলার পুষ্টিগুণ:

নাম

পরিমাণ

ভিটামিন A

৪৭০ IU 

 

ভিটামিন C

৮৪ মিলিগ্রাম

ফ্যাট

০.২ গ্রাম

ফাইবার

২.৮ গ্রাম

প্রোটিন

১ গ্রাম

কার্বোহাইড্রেট

৩.৭ গ্রাম

শক্তি

১৭ কিলোক্যালোরি

লৌহ

০.৪৩ মিলিগ্রাম

পটাশিয়াম

৩১৯ মিলিগ্রাম

ফোলেট

৭২ মাইক্রোগ্রাম

শর্করা

১.৫ গ্রাম

ক্যালসিয়াম

১৯ মিলিগ্রাম

 

তিতা করলার অপকারিতা:

যদিও তিতা করলার অনেক উপকারিতা রয়েছে, তবে অতিরিক্ত পরিমাণে খেলে কিছু অপকারিতা হতে পারে:

অতিরিক্ত খেলে ডায়রিয়া, বমি বা মাথা ঘোরা হতে পারে।

কিছু মানুষের করলার প্রতি অ্যালার্জি থাকতে পারে। 

ডায়াবেটিসের ওষুধের সাথে করলা খেলে রক্তের শর্করা অতিরিক্ত কমে যেতে পারে।

কিছু মানুষের জন্য করলার তিক্ত স্বাদ অস্বস্তিকর হতে পারে।

গর্ভবতীদের জন্য কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে (বিশেষ করে কাঁচা অবস্থায়)। 

তিতা করলা এর  চাষাবাদ:

তিতা করলা চাষাবাদ সম্পর্কে বিস্তারিত নিচে দেওয়া হলো:

জমি নির্বাচন ও প্রস্তুতি:

বেলে দোআঁশ মাটি ও ভাল জল নিষ্কাশনব্যবস্থাযুক্ত জমি তিতা করলার জন্য উপযুক্ত।

জমিতে প্রথমে ২-৩ বার চাষ দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করতে হয়।

শেষ চাষের সময় গোবর/কম্পোস্ট সার ও বীজতলার জন্য টিএসপি, এমওপি, ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হয়।

বীজ বপন সময়:

বাংলাদেশে সাধারণত ফাল্গুন থেকে আষাঢ় মাসে তিতা করলা চাষ করা হয়।

বীজ বপনের ১৫ দিন আগে চারা তৈরি করা যায়, বা সরাসরি জমিতে বপন করা যায়।

বীজ হার ও দূরত্ব:

প্রতি হেক্টরে ২.৫৩.৫ কেজি বীজ প্রয়োজন।

চারা বা বীজ ১.৫-২ ফুট দূরত্বে রোপণ করা হয়।

পরিচর্যা:

মাচা তৈরি করলে গাছ দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং বেশি ফলন হয়।

আগাছা পরিষ্কার, মাটি নিড়ানী, প্রয়োজন অনুযায়ী পানি ও কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়।গাছ বড় হলে লতা মাচার ওপরে উঠিয়ে দিতে হয়।

সার প্রয়োগ:

প্রতি শতকে: ইউরিয়া ৫০০ গ্রাম, টিএসপি ৩০০ গ্রাম, এমওপি ২০০ গ্রাম।

ইউরিয়া তিন কিস্তিতে প্রয়োগ করা ভালো।

রোগবালাই ও প্রতিকার:

পাউডারি মিলডিউ, ডাউনি মিলডিউ, ফল পচা রোগ হতে পারে। 

প্রতিকার: ছত্রাকনাশক ছিটানো (যেমন টিল্ট, রিডোমিল)। 

ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ হতে পারে। 

প্রতিকার: কীটনাশক বা ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার।

ফল সংগ্রহ:

বপনের ৫০-৬০ দিন পর প্রথম ফল পাওয়া যায়।

ফল নরম ও সবুজ থাকা অবস্থায় তুলতে হয়।

১ গাছে প্রায় ১৫-২০টি ফল পাওয়া যায়।

উৎপাদন:  প্রতি হেক্টরে ১২-১৫ টন পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়।

তিতা করলার অর্থনৈতিক গুরুত্ব:

তিতা করলা কৃষকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ফসল। এটি বাজারে ভালো দাম পায় এবং এর চাহিদা বাড়ছে। করলা চাষ করে কৃষকরা তাদের আয় বাড়াতে পারেন এবং এটি স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটাতে পারেন। তিতা করলা চাষে খরচ কম, ফলন ভালো এবং বাজারে চাহিদা বেশি। এটি স্থানীয় বাজার ছাড়াও বিদেশে রপ্তানিযোগ্য সবজি। কৃষকদের জন্য এটি একটি লাভজনক ফসল হিসেবে বিবেচিত।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

শসা(Cucumber)

কাকরোল (Spiny Gourd)

টমেটো(Tomato)