খেজুর(Date)

খেজুরের পরিচিতি:
খেজুর (ইংরেজি: Date, বৈজ্ঞানিক নাম: Phoenix dactylifera) হলো একটি জনপ্রিয় ও
পুষ্টিকর ফল, যা প্রধানত মরু অঞ্চলে জন্মায়।
খেজুর (Date)
পাম পরিবারের একটি ফল যা মূলত মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার
মরুভূমি অঞ্চলে প্রধান খাদ্য ও সম্পদের উৎস।
এটি খেজুর গাছের ফল, যা দেখতে নারকেল বা তাল গাছের মতো লম্বা ও পাতলা।
খেজুর গাছ সাধারণত শুষ্ক ও উষ্ণ আবহাওয়ায় ভালো জন্মে এবং একবার ফল ধরলে বহু বছর
ধরে ফলন দেয়। এটি মিষ্টি, সুস্বাদু এবং পুষ্টিগুণে ভরপুর, এবং সতেজ ও
শুকনো উভয়ভাবেই খাওয়া যায়। খেজুর গাছ থেকে ফল
পেতে কয়েক বছর সময় লাগে এবং একটি পরিপক্ক গাছ প্রতি মৌসুমে প্রচুর পরিমাণে ফল
উৎপাদন করতে পারে। খেজুর
গাছ সাধারণত 20 থেকে 30 ফুট পর্যন্ত উঁচু হয় এবং 30-40
বছর পর্যন্ত ফলন দিতে পারে।
খেজুরের
উৎপত্তি:
ধারণা করা হয়,মেসোপটেমিয়া
অঞ্চলে (বর্তমান ইরাক)অর্থাৎ পারস্য উপসাগরের
তীরবর্তী দেশগুলিতে খেজুরের উৎপত্তি হয়েছিল । খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ বছর আগে থেকেই মেসোপটেমিয়া এবং প্রাচীন মিশরের মানুষ এই ফল
সম্পর্কে জানতো এবং এর চাষাবাদ করত। এটি
প্রাচীন মিশর, ব্যাবিলন
ও সিন্ধু সভ্যতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য ছিল।
আজকের গৃহপালিত খেজুর গাছটি মূলত
মেসোপটেমিয়া থেকে এসেছে এবং এটি মানব সভ্যতার ইতিহাসে একটি অত্যন্ত প্রাচীন এবং
গুরুত্বপূর্ণ ফল হিসেবে বিবেচিত হয়।
বাংলাদেশেও শীতকালে খেজুরের রস আহরণ করে পাটালি গুড় ও খেজুর গুড় তৈরি করা হয়।
খেজুরের জাত:
নাম |
বৈশিষ্ট্য |
আজওয়া খেজুর
|
আসল
আজওয়া খেজুর অন্যান্য খেজুরের তুলনায় ছোট। আজওয়া খেজুরের চামড়া পাতলা এবং
চকচকে। আজওয়া খেজুর সামান্য আর্দ্র, শুষ্ক বা ভেজা
নয়। আসল আজওয়া খেজুর বাদামী-কালো রঙের। |
কালমি
খেজুর |
ভালো কালমি খেজুরের চামড়া চকচকে
ও উজ্জ্বল হয়। এটি কালচে-খয়েরি রঙের হয়। কালমি খেজুর সাধারণত লম্বাটে ও
গোলাকার হয়।
|
মাবরুম
খেজুর |
বাইরে কালচে-বাদামী এবং ভেতরে
হালকা বাদামী রঙের। পাতলা, চকচকে এবং
মসৃণ। মাবরুম খেজুর মাঝারি আকারের (3-4 সেমি) এবং
গোলাকার। |
জিহাদি
খেজুর |
জিহাদি
খেজুর”
বলতে কোন নির্দিষ্ট খেজুরকে বোঝায় না। এটি মদিনা অঞ্চলে
উৎপাদিত হয়। |
মরিয়ম
খেজুর |
মরিয়ম
খেজুর সাধারণত লম্বা হয় এবং খুব নরম হয় না। এগুলি বাদামী বা কালো এবং খেজুরের
বাইরের অংশ আঁধার এবং গাঢ়।
|
কালাস |
রং হালকা বাদামি, স্বাদে খুবই ভালো।
|
আম্বার |
গাঢ় বাদামি রঙের, মাংসল ও শক্ত খোসা। |
মেদজুল |
বড় আকার, নরম, রসাল ও অত্যন্ত
মিষ্টি। মরক্কো, জর্ডান, আমেরিকা ও
ইসরায়েলে ব্যাপক চাষ হয়।
|
দেগলেত নুর |
তিউনিসিয়া ও আলজেরিয়ার বিখ্যাত জাত। স্বচ্ছ বাদামি রঙ, মাঝারি আকার।
|
বারহি |
ছোট ও গোলাকৃতির, মিষ্টি ও নরম। |
সাগাই |
সোনালি ও বাদামি রঙের মিশ্রণ। মিষ্টি ও নরম, সৌদি আরবে জনপ্রিয়।
|
সুক্কারী |
রং হালকা বাদামি ও নরম গঠনবিশিষ্ট। খুবই মিষ্টি স্বাদের খেজুর।
|
বাংলাদেশে খেজুরের কিছু
স্থানীয় জাত:
গুড় খেজুর (রসের জন্য
বিখ্যাত)।
পাটলির খেজুর।
দেশি খেজুর।
খেজুরের উপকারিতা:

১।হজমে সাহায্য করে: খেজুরে থাকা উচ্চ মাত্রার ফাইবার বা আঁশ হজম প্রক্রিয়া উন্নত করে ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য
করে।
২।হার্ট সুস্থ রাখে:পটাশিয়াম সমৃদ্ধ খেজুর রক্তচাপ
নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং ক্ষতিকারক এলডিএল কোলেস্টেরল কমিয়ে হৃদরোগের ঝুঁকি
কমায়।খেজুরে পটাসিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম
থাকে যা হৃদযন্ত্রকে সুস্থ রাখতে সহায়তা করে এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে।
৩।শক্তি
যোগায়:খেজুরে উচ্চ পরিমাণে প্রাকৃতিক শর্করা (গ্লুকোজ, ফ্রুকটোজ, এবং সুক্রোজ) থাকে যা শরীরচর্চার পর বা ক্লান্ত লাগলে
খুব উপকারী কারণ দ্রুত শক্তি প্রদান করে। তাই এটি
ব্যায়ামের আগে বা পরে খাওয়া উপকারী।রোজা রাখার পর ইফতারে খেজুর খেলে ক্লান্তি দূর হয়।
৪।হাড়
মজবুত করে: ক্যালসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ ও ফসফরাস এর মতো খনিজ উপাদান থাকায় খেজুর হাড়ের স্বাস্থ্য উন্নত করে এবং হাড়কে
মজবুত করে।অস্টিওপোরোসিস প্রতিরোধে সহায়ক।
৫।রক্তাস্বল্পতা প্রতিরোধ করে: খেজুরে প্রচুর পরিমাণে লোহিত কণিকা তৈরির জন্য
প্রয়োজনীয় আয়রন থাকে, যা
রক্তস্বল্পতা কমাতে সাহায্য করে।খেজুরে আয়রন থাকে, যা রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়াতে।
৬।ভালো ঘুম হতে
সাহায্য করে:খেজুরে
মেলাটোনিন হরমোন নিঃসরণে সহায়তা করে বিধায় রাতে ভালো ঘুম হতে সাহায্য করে।
৭।অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট
সমৃদ্ধ:খেজুরে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান রয়েছে, যা শরীরকে ফ্রি র্যাডিকেলের ক্ষতি থেকে রক্ষা করে এবং বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি কমায়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
৮।মস্তিষ্কের
কার্যকারিতা বাড়ায়:এতে থাকা
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও ভিটামিন বি-৬ মস্তিষ্কের কার্যকারিতা উন্নত করে ও মনোযোগ
বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।খেজুর
মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য উন্নত করতে এবং মানসিক স্বাস্থ্য বাড়াতে সাহায্য করে।স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করে।।
৯।কৃত্রিম চিনির
বিকল্প:যারা কৃত্রিম চিনি এড়িয়ে চলতে চান, তাদের জন্য খেজুর একটি
স্বাস্থ্যকর ও প্রাকৃতিক মিষ্টির বিকল্প।
১০।গর্ভবতী ও
স্তন্যদানকারী মায়েদের জন্য উপকারী:গর্ভবতী মহিলাদের জন্য খেজুর খাওয়া উপকারী, কারণ এটি শরীরের শক্তি বাড়ায় এবং প্রসবের সময় সহায়তা করে।খেজুরে থাকা পুষ্টি উপাদান যেমন ফাইবার, আয়রন, ফলিক অ্যাসিড, প্রোটিন ইত্যাদি মা ও শিশুর স্বাস্থ্য রক্ষায় সাহায্য করে।
খেজুর সম্পর্কে হাদিসে যা আছে: সা’দ (রাঃ) বলেন, আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি- যে ব্যক্তি ভোরে সাতটি আজওয়া খেজুর খাবে,
সেদিন কোন বিষ ও যাদু-টোনা তার ক্ষতি করতে পারবে না।[বুখারী ও মুসলিম]
১০০ গ্রাম
খেজুরে থাকা পুষ্টি উপাদান:
ক্যালোরি: প্রায় ২৭৭ কিলোক্যালোরি
কার্বোহাইড্রেট: প্রায় ৭৫ গ্রাম
ডায়েটারি
ফাইবার: প্রায় ৬.৭ গ্রাম
পটাশিয়াম: প্রায় ৬৫৭ মিলিগ্রাম
ম্যাগনেসিয়াম: প্রায় ৫৪ মিলিগ্রাম
শর্করা:
প্রায় 66.5 গ্রাম
ফাইবার:
প্রায় 7 গ্রাম
প্রোটিন:
প্রায় 2 গ্রাম
চর্বি: প্রায়
0.15 গ্রাম
ক্যালসিয়াম:
৬৪ মিলিগ্রাম
আয়রন: ০.৯
মিলিগ্রাম
ভিটামিন বি৬:
০.২৪ মিলিগ্রাম
ফসফরাস: ৬২
মিলিগ্রাম
জিংক: ০.৪৪
মিলিগ্রাম
খেজুরে
কোলেস্টেরল নেই।
এটি শক্তি ও
ফাইবারের দারুণ উৎস।
খেজুরের অপকারিতা:

প্রায় সব খাবারের ভালো ও খারাপ দুটি দিক আছে।খেজুর পুষ্টিকর ও উপকারী একটি ফল হলেও
অতিরিক্ত খাওয়ার ফলে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে।খেজুরের কিছু
অপকারিতা নিচে উল্লেখ করা হলো:
১।অধিক শর্করা
খেজুরে অধিক পরিমাণে শর্করা থাকে, তাই ডায়াবেটিস রোগীদের এটি অতিরিক্ত পরিমাণে খাওয়া
উচিত নয়। এটি রক্তে শর্করার স্তর বাড়াতে পারে।
২।রক্তে
চিনি বাড়ায়:
খেজুরে প্রাকৃতিক চিনি
(গ্লুকোজ, ফ্রুক্টোজ, সুক্রোজ) বেশি থাকে। ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য অতিরিক্ত
খেজুর খাওয়া রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে।
৩।ওজন
বৃদ্ধি
যেহেতু খেজুর উচ্চ
ক্যালোরিযুক্ত ফল,তাই
অতিরিক্ত খেলে ওজন বাড়তে পারে। যারা ওজন কমাতে চান ও শারীরিক পরিশ্রম কম করেন,তাদের জন্য এটি সীমিত পরিমাণে খাওয়া উচিত।
৪।দাঁতের
ক্ষতি:
খেজুরে চিনি থাকায় এবং আঠালো প্রকৃতির হওয়ায় অতিরিক্ত খেলে দাঁতে ক্যাভিটি বা ক্ষয় হতে পারে, যদি ঠিকভাবে দাঁত পরিষ্কার না করা হয়।
৫।হজমের সমস্যা
খেজুরে ফাইবার বেশি থাকায়
অতিরিক্ত খেলে কিছু মানুষের হজমের সমস্যা হতে পারে, পেট ফাঁপা, গ্যাস বা ডায়রিয়া হতে পারে। যাদের হজমশক্তি দুর্বল, তাদের সাবধানে খেতে হবে।
৬।অ্যালার্জি সমস্যা
অল্প কিছু মানুষের
খেজুরের প্রতি এলার্জি থাকতে পারে। খেজুর খাওয়ার পর অ্যালার্জি (চুলকানি, র্যাশ, গলা চুলকানো, নিঃশ্বাসে কষ্ট) হতে পারে। যা তাদের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
৭।কিডনি রোগীর সমস্যা
খেজুরে পটাশিয়াম থাকে।
যারা কিডনি রোগে ভুগছেন বা পটাশিয়ামের ভারসাম্য রাখতে সমস্যা হয়, তাদের জন্য বেশি খেজুর বিপজ্জনক হতে পারে।
৮।শ্বাসকষ্টের
সমস্যা
যারা শ্বাসকষ্টে ভুগছেন তাদের জন্য খেজুর ক্ষতিকর হতে পারে এবং তাদের খেজুর
এড়িয়ে চলা উচিত।
খেজুরের চাষাবাদ:
খেজুর মরু উদ্ভিদ যা গরম
ও শুষ্ক জলবায়ুতে ভালোভাবে জন্মায়।প্রধানত মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ায় চাষ হয়।তবে সম্প্রতি বাংলাদেশে
দক্ষিণাঞ্চলে এর চাষ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।
জলবায়ু ও মাটি:খেজুর গরম
ও শুষ্ক জলবায়ু পছন্দ করে। কম বৃষ্টি ও প্রচুর রোদ প্রয়োজন।২৫ডিগ্রী
থেকে ৪৫ডিগ্রী
সেলসিয়াস পর্যন্ত সহনশীল।বেলে
দোআঁশ মাটি ও সেচনির্ভর মাটি ভালো। পানি জমে থাকে না এমন জমি উপযোগী।
চারা রোপণ:সাধারণত চারা
বা অফসেট দিয়ে খেজুর চাষ হয়। তবে বীজ থেকেও গাছ জন্মালে ফল দিতে সময় বেশি নেয়।রোপণের
জন্য ৩০-৪৫ দিন বয়সী সুস্থ চারা নির্বাচন করতে হয়।৮-১০ মিটার দূরত্বে গর্ত করে
রোপণ করা হয়।
পরিচর্যা:শুষ্ক মৌসুমে
১৫-২০ দিন পরপর সেচ প্রয়োজন।প্রতি ১-২ মাস পরপর আগাছা পরিষ্কার করা দরকার।গোবর, টিএসপি, ইউরিয়া ও পটাশ প্রয়োগ করা যায়।
রোগ-বালাই:খেজুর
তুলনামূলকভাবে রোগ প্রতিরোধী হলেও
পোকামাকড় ও ছত্রাকের আক্রমন দেখা দিলে কীটনাশক ব্যবহার করা
যায়।
ফুল ও ফল:খেজুর গাছে
স্ত্রী ও পুরুষ ফুল আলাদা গাছে হয়। পরাগায়ণের জন্য পুরুষ গাছের পরাগ স্ত্রী গাছে
ছিটিয়ে দিতে হয়।সাধারণত ফল ধরতে ৫-৬ বছর লাগে।ফল পাকতে সময় লাগে ৫-৬ মাস।খেজুর ফল
সাধারণত জুন-জুলাই মাসে সংগ্রহ করা হয়।
মন্তব্যসমূহ