লিচু (Litchi)
লিচু (litchi)
লিচু এর বৈজ্ঞানিক নাম: Litchi Chinensis
এটি Sapindaceae পরিবারভুক্ত একটি রসালো ও মিষ্টি গ্রীষ্মকালীন
ফল হিসেবে পরিচিত এবং বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় জনপ্রিয়।
উৎপত্তি:
লিচুর উৎপত্তি দক্ষিণ চীন থেকে।এটি দক্ষিণ-পূর্ব চীনের কুয়াংতুং এবং ফুচিয়েন প্রদেশের গ্রীষ্মমণ্ডলীয়
অঞ্চলের স্থানীয় উদ্ভিদ। সেখানে একাদশ শতক থেকে এর চাষাবাদ হওয়ার কথা লিপিবদ্ধ
আছে।চীন হল প্রধান লিচু উৎপাদনকারী দেশ, এরপরেই আছে
ভারত, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশ, ভারতীয়
উপমহাদেশ, মাদাগাস্কার এবং
দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশগুলো।বর্তমানে এটি ভারত, বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম এবং
অন্যান্য দক্ষিণ এশীয় দেশগুলিতে ব্যাপকভাবে চাষ করা হয়। বাংলাদেশে বিশেষ করে
দিনাজপুর, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ অঞ্চলে
লিচুর ভালো ফলন হয়। লিচু গাছ একটি লম্বা
চিরহরিৎ গাছ। এই গাছ থেকে রসাল শাঁসযুক্ত ছোট ছোট ফল পাওয়া যায়। ফলটির বহিরাবরণ
অমসৃণ ও লালচে গোলাপি বর্ণের; যা খাওয়া যায় না।
আবরণটির ভেতরে থাকে সুমিষ্ট রসাল শাঁস। বিভিন্ন মিষ্টিজাতীয় খাবারের সাথে এটি
পরিবেশন করা হয়।
লিচুর বিভিন্ন জাত:
লিচুর বিভিন্ন জাত বাংলাদেশে চাষাবাদ হয়।
এসব জাত গুণগতমান, ফলের
আকৃতি, স্বাদ, রঙ, পাকার সময়
ইত্যাদির ভিত্তিতে ভাগ করা হয়। নিচে লিচুর কিছু প্রধান জাত উল্লেখ করা হলো:
১. বোম্বাই লিচু:আকৃতিতে
বড় ও রসালো।খুব সুস্বাদু।মে মাসে পাকে।বাণিজ্যিকভাবে খুব জনপ্রিয়।
২. চায়না-৩ (China-3):মাঝারি আকৃতির।মিষ্টি
ও খোসা পাতলা।ফলন ভালো।রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি।
৩. রানিপছন্দ:আকারে মাঝারি।স্বাদে মিষ্টি ও রঙ হালকা।স্থানীয়ভাবে পরিচিত।
৪. মুজাফফরনগর:ভারত থেকে আগত জাত।সুস্বাদু, ফল বড়।মে-জুনে
পাকে।
৫. দি-হাঙ্গ:নতুন জাত।চীন থেকে এসেছে।ফলন ও
গুণগত মান ভালো।
৬. মাদ্রাজি (Madrazi):আকারে ছোট।দ্রুত
পাকে।ফলন একটু কম।রোপণের ৪-৫ বছরেই ফল
দেওয়া শুরু করে।
৭. বেদানা:বীজ ছোট বা প্রায়
নেই।অত্যন্ত রসালো ও মিষ্টি।উচ্চ দামে বিক্রি
হয়।
প্রতিটি জাতের লিচু চাষের উপযোগিতা নির্ভর
করে অঞ্চল, জলবায়ু ও
মাটির গুণমানের উপর। উন্নত জাত বাছাই করলে ফলন ও লাভ উভয়ই বেশি হয়।
পুষ্টি উপাদান:
লিচু পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ। এতে রয়েছে:
ভিটামিন সি: লিচুতে উচ্চ পরিমাণে ভিটামিন
সি রয়েছে, যা
শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।
ভিটামিন বি: এতে ভিটামিন বি৬ এবং
রিবোফ্লাভিন রয়েছে, যা শক্তি
উৎপাদনে সাহায্য করে।
মিনারেল: লিচুতে পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম, এবং
ম্যাগনেসিয়ামের মতো মিনারেল রয়েছে, যা হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট:অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে, যা শরীরের কোষকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে।
চাষাবাদ:
লিচুর চাষাবাদ
লিচু বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় মৌসুমি ফল।
সুস্বাদু ও রসালো এই ফলটি বাণিজ্যিকভাবে চাষ করলে ভালো লাভ পাওয়া যায়। নিচে লিচুর
চাষাবাদের ধাপগুলো তুলে ধরা হলো:
১. আবহাওয়া ও মাটি:
লিচু গাছ উষ্ণ এবং আর্দ্র আবহাওয়া পছন্দ
করে। এটি সাধারণত ২০-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ভালোভাবে বৃদ্ধি পায়। লিচু
গাছ শীতল আবহাওয়া সহ্য করতে পারে না, তাই ঠান্ডা অঞ্চলে চাষ করা উচিত নয়।মাটিলিচু গাছের জন্য উর্বর, বালুকাময় এবং জল
নিষ্কাশনের জন্য উপযুক্ত মাটি প্রয়োজন। মাটির pH স্তর ৬-৭ এর মধ্যে হওয়া উচিত। ভারী মাটি
বা জলাবদ্ধ মাটি লিচু গাছের জন্য উপযুক্ত নয়।
২. চারা রোপণ:
সাধারণত লিচুর
চারা রোপণের জন্য উপযুক্ত সময় হলো জুন-জুলাই মাস। তবে, লিচু গাছের চাষের
জন্য সাধারণত কাটিং পদ্ধতি বেশি ব্যবহৃত হয়। কাটিং পদ্ধতিতে, লিচুর একটি
স্বাস্থ্যকর শাখা কেটে নিয়ে মাটিতে রোপণ করা হয়।গাছের মাঝের দূরত্ব ২০ থেকে ২৫ ফুট
রাখা ভালো।
৩. গর্ত তৈরি ও সার প্রয়োগ:
প্রতি গাছের জন্য ৩×৩×৩ ফুট গর্ত খুঁড়ে
মাটি রোদে শুকাতে দিতে হবে।গর্তে ১০-১৫ কেজি গোবর, ২০০ গ্রাম টিএসপি, ২০০ গ্রাম এমওপি
ও ৫০ গ্রাম দস্তা সার মিশিয়ে দিতে হবে।
৪. সেচ ও আগাছা দমন:গ্রীষ্মকালে নিয়মিত
সেচ দিতে হবে, বিশেষ
করে ফুল ও ফল আসার সময়।আগাছা পরিষ্কার রাখতে হবে যাতে গাছের পুষ্টি নষ্ট না হয়।
৫. রোগ ও পোকামাকড় দমন:ছত্রাকজনিত রোগ ও
পাতা ঝরা রোধে প্রয়োজন অনুযায়ী ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করতে হবে।ফলের পোকার আক্রমণ হলে
কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে (বিশেষজ্ঞের পরামর্শে)।
৬. ফুল ও ফল ধরা:গাছে ফুল আসে সাধারণত
ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে।ফল পাকে মে-জুন মাসে।
৭. ফল সংগ্রহ:ফুল ফোটার ২–২.৫ মাস পর ফল
সংগ্রহ করা যায়।পরিপক্ব হলে হাত দিয়ে বা ছুরি দিয়ে থোকা ধরে ফল সংগ্রহ করা হয়।
ব্যবহার:
পাকা লিচু সরাসরি খাওয়া হয়।
লিচু দিয়ে জুস, আইসক্রিম ও শরবত তৈরি করা হয়। এটি
সালাদ, ডেজার্ট, এবং ফলের চাটে ব্যবহার করা হয়।কেক, পুডিং, জেলি ও বিভিন্ন মিষ্টান্নে
ব্যবহার হয়।
লিচুর রস ত্বককে উজ্জ্বল ও হাইড্রেটেড করতে সাহায্য করে। যা গ্রীষ্মের জন্য একটি Refreshing পানীয়।
উপকারিতা:
ভিটামিন C সমৃদ্ধ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর ত্বক ও চুলের জন্য উপকারী।পটাসিয়াম ও ফাইবার হজমে সাহায্য করে, হৃদপিণ্ড ভালো রাখে ।গ্রীষ্মকালে ক্লান্তি দূর করে । রসালো ফলে পানির পরিমাণ বেশি থাকায় ত্বক সতেজ রাখে।
অপকারিতাঃ
অতিরিক্ত খেলে পেট ব্যথা, বমি বা ডায়রিয়া হতে পারে।
খালি পেটে বেশি লিচু খেলে Hypoglycemia (রক্তে শর্করার মাত্রা কমে যাওয়া) হতে পারে, বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে । লিচুতে উচ্চ পরিমাণে শর্করা রয়েছে, তাই ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য এটি সীমিত পরিমাণে খাওয়া উচিত। কিছু মানুষের লিচুর প্রতি অ্যালার্জি থাকতে পারে, যা খাওয়ার পর অস্বস্তি সৃষ্টি করতে পারে।